বাস্তুশাস্ত্রে বিভিন্ন প্রকারের ভূখণ্ডের বর্ণনা করা হয়েছে। সাধারণত দুটি অংশে তা ভাগ করা হয়েছে।
১। ভূমির বিভিন্ন দিকে উঁচু অথবা নিচু স্থান। ২। আকারের ভিত্তিতে। প্রথমোক্ত ঢালু ভূখণ্ড সম্পর্কে জানার আগে আমাদের বিভিন্ন দিকের ভূমির উঁচু অথবা নিচু থাকার পরিণাম কী হতে পারে সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানা দরকার।
বিভিন্ন দিকে ভূমি ঢালু হওয়ার শুভাশুভ :
পূর্ব দিকে ঢালু থাকলে সেটি হবে ধনদায়ী ও উন্নতিকারী।
আগ্নেয় দিকে ঢালু থাকলে কষ্ট, মৃত্যু ও পীড়াদায়ী।
দক্ষিণ দিকে ঢালু থাকলে যশোহানি ও পুত্রহানি।
নৈর্ঋত দিকে ঢালু থাকলে যশোহানি ও পুত্রহানি।
পশ্চিম দিকে ঢালু থাকলে ধনহানি ও পীড়াদায়ী।
বায়ব্য দিকে ঢালু থাকলে উদ্বেগ ও প্রবাসকারী।
উত্তর দিকে ঢালু থাকলে ধনদায়ী।
ঈশান দিকে ঢালু থাকলে বিদ্যা, ধনধান্য, সুখদায়ী।
মধ্য স্থানে ঢালু যুক্ত জমি হয় অনিষ্টকারী।
বিভিন্ন দিকে ভূম উঁচু হওয়ার শুভাশুভ :
পূর্ব দিকে ভূমি উঁচু থাকলে সন্তানহানি।
আগ্নেয় দিকে উঁচু থাকলে ধনলাভ।
দক্ষিণ দিকে উঁচু থাকলে সেই ভুমি রোগ সৃষ্টিকারী।
নৈর্ঋত দিকে ভূমি উঁচু থাকলে সন্তান লাভ।
বায়ব্য দিকে উঁচু থাকলে ধননাশ।
উত্তর দিকে উঁচু হলে সেই ভূমি রোগ সৃষ্টিকারী।
ঈশান দিকে ভূমি উঁচু হলে তা হবে ক্লেশ সৃষ্টিকারী ও অমঙ্গলকারক।
পশ্চিম দিকে ভূমি উঁচু হলে হল তা সুখদায়ক।
উচ্চতা ও ঢালুর ভিত্তিতে বিভিন্ন প্রকারের ভূখণ্ড : আমরা যে ভূখণ্ড বাস্তুর জন্য ব্যবহার করি সেই ভূখণ্ড নানা ধরণের হয়। সেই ভূমির ঢালও নানা দিকে থাকে। ঢাল অনুসারে বিভিন্ন প্রকারের জমিকে বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়। এদের মোট ২৬ প্রকারে বিভক্ত করা হয়েছে। নিম্নে তারই বিশদ বর্ণনা দেওয়া হল। সঙ্গের চিত্রগুলিতে প্রতিটি জমির ঢাল বুঝাতে উঁচু দিকটি (+) চিহ্নযুক্ত এবং নিচু দিকটি (-) চিহ্নযুক্ত নির্দেশিত হয়েছে। জমির দিকগুলি অধ্যায় শুরুতে নির্দেশিত দিক অনুসারে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন, পূর্ব (-) চিহ্নযুক্ত, পশ্চিম (+) চিহ্নযুক্ত, উত্তর (+) চিহ্নযুক্ত এবং দক্ষিণ (-) চিহ্নযুক্ত।
১। গোবীথি : পশ্চিম দিকে উঁচু ও পুর্ব দিকে ঢালু থাকলে সেই ভূমিকে গোবীথি বলা হয়। এই ধরণের ভুমিতে সন্তান লাভ হয়। (চিত্র-১)
২। জলবীথি : উত্তর দিকে উঁচু ও দক্ষিণ দিকে ঢালু থাকলে সেই জমি জলবীথি। এ ধরণের ভূমিতে সন্তান লাভ হয় । ( চিত্র-২)
৩। যমবীথি : উত্তর দিকে উঁচু ও দক্ষিণ দিকে ঢালু থাকলে সেই জমিকে যমবীথি বলা হয়। এই ভূমি স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর (চিত্র-৩) চিত্র:
৪। গজবীথি : দক্ষিণ দিক উঁচু ও উত্তর দিকে ঢালু জমি গজবীথি। এই ধরণের জমি আরোগ্যকারী ( চিত্র -৪)
৫। ভূতবীথি : ঈশাণ দিকে উঁচু ও নৈর্ঋত দিকে ঢালু থাকলে সেই জমিকে ভূতবীথি বলা হয়। এর ফল কষ্টদায়ী (চিত্র-৫)
৬। নাগবীথি : আগ্নেয় দিকে উঁচু ও বায়ব্য দিকে ঢালু হলে সেই ভূমি নাগবীথি। এই ধরণের ভূমি অর্থ লাভ প্রদানকারী (চিত্র – ৬)
৭। ধনবীথি : নৈর্ঋত দিকে উঁচু ও ঈশান দিকে ঢালু হলে সেই ভূমিকে ধনবীথি বলা হয়। এ ধরণের জমি প্রচুর ধনদায়ী।
৮। বৈশ্বানরবীথি : বায়ব্য দিকে উঁচু ও আগ্নেয় দিকে ঢালু ভূমি বৈশ্বানরবীথি। এ ধরণের জমি ধননাশকারী।
৯। পিতামহ বাস্তু : যে ভূমি পূর্ব ও আগ্নেয় দিকের মাঝখানে সর্বাধিক উঁচু এবং পশ্চিম ও বায়ব্য দিকের মাঝখানে সর্বাধিক নিচু থাকে তাকে পিতামহ বাস্তু বলা হয়। এ ধরণের ভূমিতে মানুষ সুখী হয়।
চিত্র:
১০। সুপন্থ বাস্তু : যে ভূমি আগ্নেয় দিক ও দক্ষিণ দিকের মাঝখানে সর্বাধিক উঁচু হবে এবং উত্তর দিক ও বায়ব্য দিকের মধ্যে সব থেকে নিচু থাকবে তাকে সুপন্থ বাস্তু বলা হয়। এই ধরণের জমি সকল রকমের কাজের পক্ষে অনুকূল।
১১। দীর্ঘায়ু বাস্তু : যদি ভূমি দক্ষিণ দিক ও নৈর্ঋত দিকের মধ্যে সব থেকে উঁচু থাকে এবং উত্তর দিক ও ঈশান দিকের মধ্যে সব থেকে নিচু থাকে তা হলে সেই ভূমি হল দীর্ঘায়ু বাস্তু। এই ধরণের ভূমিতে বংশ বৃদ্ধি হয়।
১২। পুণ্যক বাস্তু : ভূমি যদি নৈর্ঋত দিক ও পশ্চিম দিকের মাঝখানে সব থেকে উঁচু হয় এবং পূর্বদিক ও ঈশান দিকে সব থেকে নিচু হয় তা হলে তাকে পুণ্যক বাস্তু বলা হয়। সমস্ত রকমের শুভ ফল এই জমিতে পাওয়া যায়।
চিত্র :
১৩। অপথ বাস্তু : যদি ভূমি পশ্চিম দিকে ও বায়ব্য দিকের মাঝখানে সর্বধিক উঁচু এবং পূর্ব দিক ও আগ্নেয় দিকে ঢালু হয় তা হলে এই ভূমি হবে অপথ বস্তু। এই ধরণের ভূমি হল শত্রুতা ও কলহের স্থান।
১৪। রোগকৃত বাস্তু : যে ভূমি বায়ব্য দিক ও উত্তর দিকের মধ্যে সব থেকে উঁচুতে থাকে এবং আগ্নেয় দিক ও দক্ষিণ দিকের মধ্যে সব থেকে নীচে থাকে তা হলে রোগকৃত বাস্তু। এই ধরণের ভূমি হল নানারকম রোগব্যাধির আস্তানা।
১৫। অর্গলা বাস্তু : ভূমি যখন উত্তর দিক ও ঈশান দিকের মধ্যে সব থেকে উঁচু থাকে এবং দক্ষিণ ও নৈর্ঋত দিকে ঢালু থাকে তখন সে জমি হবে অর্গলা বাস্তু। এই জমি ভয়ঙ্কর ধরণের পাপ নষ্ট করে দেয়।
চিত্র :
১৬। শ্মশান বাস্তু : ভূমি যদি ঈশান দিক ও পূর্ব দিকের মধ্যে সব থেকে উঁচুতে থাকে এবং নৈর্ঋত দিক ও পশ্চিম দিক সব থেকে নিচু হয় তা হলে সে জমিকে শ্মশান বাস্তু বলা হয়। এই ভূমিতে কুল বা বংশ হানি ঘটে।
১৭। শ্যেনক বাস্তু : যে ভূমি নৈর্ঋত, বায়ব্য ও ঈশান দিকে সব থেকে উঁচু হবে এবং আগ্নেয় দিকে সব থেকে নিচু সেটি হল শ্যেনক বাস্তু। এর ফল হয় মৃত্যু।
১৮। স্বমুখ বাস্তু :যে ভূমি বায়ব্য, ঈশান ও আগ্নেয় দিকে সব থেকে উঁচু, উত্তর ও নৈর্ঋত দিকে সব থেকে নিচু, সেটি হল স্বমুখ বাস্তু। এই ভূমি দারিদ্র প্রদান করে। চিত্র :
১৯। ব্রাহ্মণ বাস্তু : যখন ভূমি ঈশাণ, আগ্নেয় ও নৈর্ঋত দিকে উঁচু এবং বায়ব্য দিকে সব থেকে নিচু তখন সেই জমি হবে ব্রাহ্মণ। এ জমি অশুভ ফলদায়ী।
২০। শাণ্ডুল বাস্তু : যে ভূমি ঈশান দিকে উঁচু এবং আগ্নেয়, নৈর্ঋত ও বায়ব্য দিকে নিচু, সেই ধরণের ভূমি হল শাণ্ডুল বাস্তু। এই বাস্তু অশুভ ফল প্রদানকারী।
২১। স্থাবর বাস্তু : যে ভূমি শুধু আগ্নেয় দিকে উঁচু এবং নৈর্ঋত, বায়ব্য ও ঈশান দিকে নিচু, তাকে স্থাবর বাস্তু বলা হয়। এ হল শুভ ফল দায়ক।
চিত্র:
২২। স্থণ্ডিল বাস্তু : যে ভূমি শুধু নৈর্ঋত দিকে উঁচু এবং বায়ব্য, ঈশান ও আগ্নেয় এই তিন দিকে নিচু, তাকে বলা হয় স’ণ্ডিল বাস্তু। এও শুভ ফলদায়ী।
২৩। সুসন্তান বাস্তু : যে ভূমি আগ্নেয়, দক্ষিণ ও নৈর্ঋত দিকে উঁচু এবং উত্তর দিকে নিচু তা হল সু্সন্তান বাস্তু। এ রকম ভূমি ব্রাহ্মণ, বিদ্বান ও অধ্যাপকদের পক্ষে শুভ।
২৪। সুতল বাস্তু : ভূমি যদি নৈর্ঋত, পশ্চিম ও বায়ব্য দিকে উঁচু থাকে এবং পূর্ব দিকে নিচু থাকে তা হলে সেটি সুতল বাস্তু। এই ভূমি দেশ বা রাজ্যের পক্ষে সমৃদ্ধশালী হয়। এ ধরণের ভূমি ক্ষত্রিয়, শাসক ও প্রশাসকদের পক্ষে অনুকূল।
চিত্র:
২৫। চর বাস্তু : যে ভূমি বায়ব্য, উত্তর ও ঈশাণ দিকে উঁচুতে থাকলেও দক্ষিণ দিকে সব থেকে নিচু থাকে তাকে চর বাস্তু বলা হয়। এ ধরণের ভূমি বৈশ্য ও ব্যবসায়ী শ্রেনীর পক্ষে অনুকূল।
২৬। শ্বমুখ বাস্তু : ভূমি যখন ঈশান, পূর্ব ও আগ্নেয় দিকে উঁচু থাকে, পশ্চিম দিকে নিচু তখন তাকে শ্বমুখ বাস্তু বলা হয়। এ ধরণের জমি সমাজের নিম্ন ও দুর্বল শ্রেণীর পক্ষে অনুকুল।
চিত্র :
জমির ঢালের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি : বাস্তুশাস্ত্রে জমির ঢাল সম্পর্কে বলা হয়েছে যে জমির ঢাল যেন একই দিকে থাকে। এবং তা উত্তর-পূর্ব দিকে হওয়াই বিধেয়। বাস্তুশাস্ত্র যে বিজ্ঞানভিত্তিক তার উত্তর পাওয়া যায় জমির ঢাল উত্তর-পূর্ব দিকে রাখার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায়। জমির ঢাল উত্তর-পূর্ব দিকে রাখা অত্যন্ত উপকারী। কেননা উত্তর-পূর্ব দিকে ঢাল করলে সমস্ত জমির পানি উত্তর-পূর্ব দিকে সঞ্চিত হবে। এই সঞ্চিত পানি ধীরে ধীরে মাটির গভীরে প্রবেশ করবে। আর উত্তর-পূর্ব দিকে বাস্তু শাস্ত্র মতে পাতকুয়া, টিউবওয়েল, পুকুর ইত্যাদির অবস্থান নির্দেশ করেছে। মাটির গভীরে সঞ্চিত পানি প্রবেশের কারণে পানির উৎসগুলির পানিস্তর কখনওই কমবে না। আবার উত্তর-পূর্ব দিক থেকে আসা সূর্যরশ্মির মধ্যে যে লাল উজানি রশ্মি আছে সেই রশ্মি উত্তর-পূর্ব দিকে থাকা পানি শোষণ করে। পানি সেই শোষিত লাল উজানি রশ্মি দুপুরের পর থেকে বিকিরিত করে।
আবার জমির দক্ষিণ-পশ্চিম দিকটি উঁচু হওয়া উচিত। কেননা ওই দিক উঁচু থাকলে পানি উত্তর-পূর্ব দিকে গড়িয়ে যায়। আবার পৃথিবী সর্বক্ষণ ২৩০১/২ ডিগ্রী উত্তর-পূর্ব দিকে কাত হয়ে ঘোরে। সেই কারণেও জমির দক্ষিণ-পশ্চিম দিক্ উঁচু হবে এবং উত্তর-পূর্বদিক্ নিচু থাকবে।
আয়ূর্বেদশাস্ত্রেও বলা হয়েছে যে এমন জমিতে বাস করা স্বাস্থ্যকর যার ঢাল উত্তর ও পূর্বদিকে আছে। এবং অবশ্যই পূর্ব ও উত্তর উম্মুক্ত থাকবে।
আটটি দিকের গুরুত্ব :
বাস্তু বিজ্ঞান অনুসারে মানবজীবনে আটটি দিকের প্রভাব অবশ্যম্ভাবী।
কোনও ভবন নির্মাণ করানোর সময় অতি অবশ্যই র্পূব দিক্টি খোলা ও ফাঁকা রাখতে হবে। পূর্ব দিক্টি হল পৈতৃক সন্তান। পূর্ব দিক্ খোলা না রাখলে পিতৃপক্ষের হানি হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
আগ্নেয় দিক্ মানবজীবনের স্বাস্থ্য প্রদান করে।
দক্ষিণ ধনধান্য, সমৃদ্ধি, প্রসন্নতা ও শান্তি দেয়।
নৈঋত নিজের আচারবিচারের জন্য দায়ী হয়। নৈঋতে কোনও রকমের গুরুতর দোষ রাখা অকালমৃত্যুকে আমন্ত্রণ জানানোর সমান।
পশ্চিম দিক্ সাফল্য, যশ ও ভদ্র ব্যবহার প্রদান করে।
বায়ব্য দিক্ অন্য ব্যক্তিদের সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ন্ত্রিত করে। বন্ধুত্ব ও শত্রুতা উভয়ই এর মধ্যে আছে।
উত্তর দিক্ হল মাতৃসন্তান। বাড়িতে উত্তর দিকে ফাঁকা সন্তান না ছাড়লে মাতৃপক্ষের হানির আশঙ্কা থাকে।
ঈশানে কোনও প্রকারের দোষ, কাটছাঁট হওয়া উচিত নয়। ঈশান বংশবৃদ্ধিকে স্থায়িত্ব প্রদান করে।